বাস্তু শাস্ত্রে রান্নাঘরের অবস্থান মানেই যেন ক্লাসের উপপাদ্যের মতো, গোটাটাই মুখস্ত করতে হবে । আর বাড়ির গিন্নীর ব্যাপার তো, তাই বিষয়টি খুব গুরুত্ত্বপুর্ন । বাড়ি করার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত্য এমনকি ঘরের রং পর্যন্ত্য বাড়ির গিন্নীরা-ই পছন্দ করেন । কেন জানি না সেই কচি কলাপাতা কলাপাতা রং যেন একটি গুরুত্ত্ব-ও রাখে । আর বাড়ির গৃহকর্তার ব্যাপার সেটা হল – তিনি অপরের তরে নিজের সমস্ত কিছু উজার করতে পাবেন কিন্তু বাড়িতে একগ্লাস জল-ও ভরে খেতে পারবেন না । রান্নাঘরের বাস্তুটা ঠিক উপরের বিষয়গুলির মতো । বাড়িই হোক বা ফ্ল্যাট – তার কিচেন অর্থাত্‍ রান্নাঘরটি বাড়ির মহিলাদের পক্ষে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ দিনের বেশির ভাগ সময়টাই বাড়ির মহিলাদের কাটাতে হয়৷ তাছাড়া এখানে যেহেতু পরিবারের সকলের জন্য খাবার তৈরি হয়, তাই ঘরটির অবস্থান এবং রান্নাঘরের প্রয়োজনীয় আসবাব ও ইলেকট্রিকাল যন্ত্রপাতি রাখার ব্যবস্থা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে যদি করা যায় তাহলে তা পরিবারের সকলের সুস্বাস্থ্য সুনিশ্চিত হবে৷
তাহলে একটু দেখি কতটা ঠিকঠাক আছে আপনার রান্নাঘর –
● বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব দিকটি নিয়ন্ত্রণ করেন অগ্নিদেবতা৷ তাই এই দিকটির নাম হল অগ্নিকোণ৷ রান্নাঘরের কাজকর্ম যেহেতু অগ্নি সম্পর্কিত তাই রান্নাঘরের অবস্থান ‘অগ্নিকোণ’-এ হওয়াই সর্বশ্রেষ্ঠ৷ সম্ভব না হলে রান্নাঘরটি উত্তর-পশ্চিমে করা যেতে পারে৷(আমার ব্যাখ্যা – বাতাসের প্রবাহমান্যতার জন্য উক্ত স্থান নির্নয় কারা হয়েছে)।
● তবে রান্নাঘর যেখানেই হোক না কেন – তা যেন বাড়ির ব্রহ্মস্থানে (অর্থাত্‍ মাঝখানে) যাতে না হয় তা সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন৷(আপনার বাস্তুবিদকে আগে ব্রহ্মস্থান নির্নয় করতে বলুন, বাস্তুর ক্ষেত্রে এটি-ই প্রথম সুত্র, এটি যদি সঠিক না হয় তাহলে সকল নির্নয়-ই ভুল হবে, সঠিক বাস্তু অ্যানালিসিস হবে না)।
● রান্নাঘরের কিচেন প্ল্যাটফর্মটি পূর্বদিকের দেওয়ালে করা উচিত যাতে পূর্বদিকে মুখ করে রান্না হয়৷( মেঝে থেকে সাধারন উচ্চতা ২’৬”, প্রশস্থ – ১’৬”- র কম হবে না )। কোনওভাবেই উত্তর বা পশ্চিমদিকে মুখ করে রান্না নয়৷শোনা যায় বাস্ত্তশাস্ত্রের এই দিক নির্দেশ মেনে চললে রান্না করা খাবার যে রকম সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হয় তেমনই অপচয়-ও বন্ধ হয়৷ মা লক্ষ্মী, মা অন্নপূর্ণার আশীর্বাদও পাওয়া যায়৷(এছাড়া আর-ও একটি বিষয় লক্ষ্য রাখা – রাধুনিকে রান্না করা জানাটা-ও প্রয়োজন)।
● কিচেন বেঞ্চে দাঁড়িয়ে রান্না করুন বা বেঞ্চ না থাকলে বসেই রান্না করুন – কোনওভাবেই যেন গ্যাস ওভেন, স্টোভ কিংবা উনানের মুখ বাড়ির প্রধান দরজা বা টয়লেটের দরজার দিকে মুখ করে বসানো না হয় তা সুনিশ্চিত করতে হবে৷(কেন ? আপনি একটু ভাবলেই উত্তর পাবেন)।
● বাড়ির ক্ষেত্রে অনেকে জায়গার অভাবে সিঁড়ির নীচেও রান্না করে থাকেন৷ এটি কোনওভাবেই বাস্ত্তসম্মত নয়৷(কেন? শাস্ত্র ব্যাখ্যা – সিঁড়ির চাতালে নিচে শনিদেবের অবস্থান, তাই চাতালের নিচে রান্না নয়, আমার দেখা কিছু বাড়িতে এমন রান্নার জন্য সে বাড়ির রোগ,ভোগ অশান্তির শেষ নেই । আমার ব্যাখ্যা – সিঁড়ির চাতালের উচ্চতা মেঝে থেকে ৫-৫’৬” হয় প্লাস্টার বাদে,বা তার থেকে ৬” বাড়তে পারে, একজন সাধারন মানুষের গড় উচ্চতা ৫’৩.৫”, তাহলে যিনি রান্না করবেন তার থেকে চাতালের উচ্চতার ফারাক একবারেই নগন্য, উক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিনীর প্রথমে কোমরের, ঘারের, মেরুদন্ডের অসুখ হবে- এটা প্রমানিত, উপরের কলমে আলোচনা করেছি চাতালের উচ্চতা মেঝে থেকে কত রাখতে হবে, তাহলে রান্নার সময় জায়গার যে অপ্রতুলতা সেটি রান্নাতে রিফ্লেক্ট হবেই , এছাড়াও রান্নার সময় তরকারি,ডাল প্রভৃতি সোমবার দেবার সময় যে ঝাঁঝ উঠবে সেটি আপনার সকল বিচরনেই প্রবেশ করবে তাতে ঘরের সকলের শারিরীক সমস্যার সৃষ্টি সহ দেওয়ালের রং-এর উপর প্রভাব পরবে)
● রান্নাঘরের ইলেকট্রিকাল সাজ-সরঞ্জাম যেমন মিক্সার, গ্রাইন্ডার, টোস্টার, মাইক্রোওভেন ইত্যাদি রাখুন রান্নাঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে৷ জায়গা না থাকলে দক্ষিণ দিকের দেওয়ালেও রাখতে পারেন৷ রান্নাঘরের গরম বাতাস বা ধোঁয়া বের করে দেওয়ার জন্য একজস্ট ফ্যান বা চিমনি ইত্যাদি লাগান দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে৷
● রান্না ঘরের কল বা জল সম্পর্কিত জিনিষ রাখুন উত্তর-পূর্ব কোণে৷ অ্যাকোয়াগার্ড, ফিল্টার, জলের জালা বা পাত্র ইত্যাদি থাকবে এই উত্তর-পূর্ব কোণেই৷
● কিচেন বেঞ্চ মার্বেল বা অন্য কোনও স্টোন দিয়ে করা যেতে পারে৷ কিন্ত্ত গ্র্যানাইট ব্যবহার না করতে পারলেই শুভ৷
● স্টেনলেস সিঙ্ক ব্যবহার করা যেতে পারে৷ মোজাইক বা মার্বেলের সিঙ্কও বসানো যায়৷ আপনার সুবিধামত এই ধরনের সিঙ্ক রান্নাঘরের দক্ষিণ দিকে বসানোর চেষ্টা করবেন৷ কোনওভাবেই উত্তর-পূর্ব দিকে বসাবেন না৷
● জায়গার অভাবে আজকাল ভাঁড়ার ঘর ব্যাপারটা উঠেই গিয়েছে৷ তবু বাড়ির ক্ষেত্রে রান্নাঘরের উত্তর-পশ্চিমে, দক্ষিণে বা দক্ষিণ-পশ্চিমে ভাঁড়ার ঘর করা যেতে পারে৷
● ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে এই ভাঁড়ার ঘরের বিকল্পই হল – কিচেন ক্যাবিনেট৷ এটি রান্নাগরের দক্ষিন বা দক্ষিণ-পশ্চিমে ভাঁড়ার ঘর করা যেতে পারে৷
● বাসনপত্র রাখার রেক দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পশ্চিম দেওয়ালেই ভালো৷
● মশলাপাতি, চাল, ডাল ইত্যাদির কৌটো যে রেক বা ক্যাবিনেটে রাখবেন তা কভারড না হওয়াই স্বাস্থ্যসম্মত, কিন্ত্ত এই সকল মশলাপাতির কৌটোর মুখ যেন কোনও সময়ই খোলা না থাকে৷
● বঁটি, ছুরি ইত্যাদি যেখানে সেখানে ফেলে রাখবেন না৷ সব সময় কোনও কভারড জায়গায় রাখার চেষ্টা করুন৷
● রোজের আবর্জনা ঢাকা দেওয়া বিনে ফেলুন৷ এই বিন রাখুন দক্ষিণ দিকে বা উত্তর পশ্চিম দিকে৷ পূর্বদিকে ডাস্টবিন রাখবেন না৷
আমরা বর্তমানে সকলেই অ্যাডজাষ্ট করা শিখে গেছিতো তাই অল্প পরিসরে যেটুকু না করলেই নয় সে টুকুই করি । ভয় পাওয়ার কিছু নেই । রান্নাঘর নিয়ে আরো অনেক অনেক ব্যখ্যা আছে, সব কিছু জানলে আপনাকে আর আপনার রান্নাঘরে রান্না করতে ইচ্ছা করবে না । তাই সামান্য কিছু আলোচনা করলাম । এই সামান্য কিছু মানলেই অনেক । সবশেষে রান্নাঘর থেকেই স্বাস্থ্যের সূচনা৷ তাই নিয়মিত এটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন৷ পরিবারের সকলের সুস্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করতে উপরিউক্ত টিপস যতটা সম্ভব মান্য করে কিংবা সুশিক্ষিত বাস্ত্ত-বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে আপনার বাড়ির রান্নাঘরটি সাজিয়ে ফেলুন একদম বাস্ত্ত পরিকল্পিত উপায়ে৷ তাহলেই সুস্বাস্থ্য, সম্পদ ও সৌভাগ্য আপনারও লাভ হতে পারে অচিরেই৷

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *